মোকাররম হোসেন, ফুলবাড়ী (দিনাজপুর) প্রতিনিধিঃ
মুক্তিযুদ্ধের সময় চারদিকে মুক্তিকামী মানুষের ছিলো হাহাকার অবস্থা। সেই সময় পাক হানাদার বাহিনী সব কিছু ধ্বংস করে দিয়েছে, পুরো এলাকা যেন বিধ্বস্ত । অনাহারে অর্ধাহারে দিশেহারা মানুষসহ গবাদি পশুরা। কোথাও কোন কাজ না থাকায় খাবারের অভাব ছিলো চরম। উপায় না পেয়ে মাঠে ঘাস তুলে সেই ঘাস ফেরি করে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করে বাবা মায়ের মুখে খাবার তুলে দিয়েছেন। এরপর থেকে সেই পেশা এখনও ধরে রেখেছেন অমল চন্দ্র দাস (৮৫)।
দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার ৭নং শিবনগর ইউনিয়নের পূর্ব রাজারামপুর (মাছুয়া পাড়া) গ্রামের বাসিন্দা অমল চন্দ্র দাস (৮৫)। ৫৩ বছর থেকে ঘাস বেচেই সংসার চলে তার। প্রতিদিন ভোরে না খেয়েই কাঁধে ভার বাউকা ও পাসুন (লোহার তৈরি ঘাস তোলার হাতিয়ার) নিয়ে মাঠে ঘাস তুলতে যান তিনি। সাথে কিছু শুকনো খাবার আর এক বোতল পানি নেন। বেলা বাড়ার পর একটুখানি জিরিয়ে নিয়ে সেই খাবার (বিস্কুট অথবা মুড়ি) খেয়ে পানি পান করেন। দুপুরেও একই খাবার খেয়ে নিজ মনে কাজ করতে থাকেন। সারাদিন মাঠে ঘাস তুলে বিকেলে সেই ঘাস পুকুরের পানিতে ধুয়ে ভারে নিয়ে ফেরি করে বাড়ি বাড়ি বিক্রি করেন তিনি। দুপুরে কেবল একমুঠো শুকনো খাবার ও পানি খেয়েই দিন কাটে তার। কোন কোন দিন তাও জোটেনা। ঝড়বৃষ্টি কিংবা প্রখর রোদেও থেমে থাকেনা তার ঘাস তোলা। অসুস্থতার কারনে যদি কোন দিন ঘাস তুলতে না পারেন তবে সেই দিন চুলায় আগুন জ্বলেনা অমল দাসের। কারন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি তিনি।
সরেজমিনে মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলার শিবনগর ইউনিয়নের রাজারামপুর গ্রামের ইটভাটার পরিত্যক্ত জমি থেকে ঘাস তুলতে দেখা যায় অমল চন্দ্র দাসকে। ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই ঘাস তুলছেন অমল দাস। বয়সের ভারে নুয়ে পড়ছে শরীর, চামড়ায় ভাঁজ পড়েছে তবুও কাজের প্রতি একটু অনিহা নেই তার। কথা হয় তার সাথে।
জানতে চাইলে ভেজা শরীর মুছতে মুছতে গাছের অমল দাস বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় চরম খাদ্য সংকটে পড়েছিলাম। সেই সময় খাবারের অভাব ছিল, কিছু ত্রাণ পাওয়া গেলেও তাতে চলত না। অবলা গবাদি পশুগুলোও না খেয়ে কষ্ট করত। ওই সময় কোন কাজকর্ম ছিলনা। তখন যুবক বয়স কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। জীবিকার তাগিদে ঘাস তুলে বিক্রি করতে লাগলাম। পরবর্তীতে এটাই আমার পেশা হয়ে যায়, তা দিয়েই এখনও সংসার চলে। তিনি বলেন, প্রতিদিন ভোর থেকে শুরু করে বিকেল পর্যন্ত সারাদিন ঘাস তুলে পুকুরের জলে ধুয়ে পরিষ্কার করে ফুলবাড়ী বাজারে নির্দিষ্ট কিছু বাড়িতে ঘাস বিক্রি করি। প্রতি ডালি ঘাস ২০টাকা হিসেবে বিক্রি করে ২০০-২৫০ টাকা পাই তা দিয়ে কোন রকমে জীবন চলে। সংসারে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে থাকলেও মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। একমাত্র ছেলে বউ নিয়ে আলাদা সংসার করে। সেও দিন মজুরের কাজ করে, অন্যের জায়গায় চালা দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকে।
আক্ষেপ করে তিনি বলেন, আগের মত তেমন আর পরিত্যক্ত জমি নেই এখন। খুব একটা ঘাসও পাওয়া যায় না, ফসলি জমির আইল, ইটভাটার পরিত্যক্ত জমি, পুকুর পাড় ও নদীর পাড়সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে ঘাস সংগ্রহ করে বিক্রি করি। ঘাস বিক্রির টাকা দিয়ে কোন রকমে অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটে আমাদের। এই বয়সে অন্য কোন কাজ করারও সামর্থ্য নাই। নিজের কোন বাড়িও নাই, অন্যের জমিতে কোন রকমে ছাপড়া দিয়ে স্বামী-স্ত্রী সেখানে থাকি।
স্থানীয় বাসিন্দা রসিক চন্দ্র রায় বলেন, ছোট বেলা থেকে দেখছি অমল দাস ঘাস তুলে বাজারে বিক্রি করে সংসার চালায়। আর্থিক ভাবে অসচ্ছল হলেও অমল দাস কারো কাছে হাত পাতেন না। কঠোর পরিশ্রম করে জরাজীর্ণ ভাবে বেঁচে আছেন।
একই এলাকার জাহাঙ্গীর আলম বলেন, অমল দাসের পেশাটি একটি ব্যতিক্রমী পেশা। দীর্ঘদিন ধরে কঠোর পরিশ্রম করে সংসার চালান তিনি। এই সময়ে অনেক কিছু পরিবর্তন হলেও অমল দাসের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। বিত্তবানদের উচিৎ এমন অসহায় ও নিরীহ মানুষের পাশে দাঁড়ানো।
শিবনগর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছামেদুল ইসলাম, অমল দাসের বিষয়টি আমার আগে জানা ছিলনা। তার বিষয়ে খোঁজ নিয়ে ইউএনও স্যারের সাথে কথা বলে তার জন্য কিছু করবো। যদি বয়স্কভাতা না পায় তবে ভাতা কার্ডের ব্যবস্থা করা সহ বাড়ির বিষয়টিও দেখবো।
Leave a Reply